সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষ ‘অভিযান’ আবার প্রমাণ করল, শেষ বলে কিছু হয় না

ফিল্মি দুনিয়ায় এখনও বায়োপিকের রমরমা চলছে। কিন্তু এরকম উদাহরণ নেই যেখানে রক্তমাংসের চরিত্র নিজেই নিজের বায়োপিকে অভিনয় করছেন। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অভিযান’ জীবন্ত দলিল হিসেবে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে গেল কিংবদন্তি বাঙালি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়— যাঁকে পুলু থেকে ফেলুদা, হাজারো নামে চেনে বাঙালি। এই ধরনের সিনেমা ভালো না খারাপ, তর্কে যাওয়া উচিতই নয়, কারণ এটি একটি memoir, যার সিলমোহর দিয়ে গিয়েছিলেন সৌমিত্র নিজেই। ‘অভিযান’ কখনও দেখবেন না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই, এই ক্ষত পূরণ হবার নয়। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে শ্যুটিং শেষ করতে পারলেও, ডাবিং শেষ করতে পারেননি, তাই কিছু জায়গায় ডকুমেন্টারির পরিচিত আদবকায়দার মতো লেগেছে। কিন্তু একটি ইন্ডাস্ট্রি সবাই এক হয়ে এগিয়ে এসেছে বাংলা সিনেমার সোনালি প্রজন্মের মহিরুহের জন্য, এই উদাহরণ খুব বেশি নেই আন্তর্জাতিক সিনেমার ইতিহাসে।

প্রথম সিনেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ— পরিচালক ধরতে চেয়েছেন সময়কে, আরও সহজ করে বললে বিভিন্ন দশককে। ছোট্ট পুলুর বেড়ে ওঠা একটি সহজ, সরল পরিবারে— তারপর বেড়ে ওঠা একটি সজীব উদ্ভিদের মতো, পর্দায় এসেছেন উনি ওঁর মতো করে। তবে পটভূমি রচনার ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা রয়েছে অবশ্যই— বিলেতের ক্যানসারের ডাক্তার সঞ্জয় সেন কলকাতায় এসেছেন স্রেফ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে গবেষণা করবেন বলে। শুরুতে না বলেছিলেন বটে, কিন্তু একমাত্র নাতির ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় আহত হওয়া সেই সিদ্ধান্তে বদল আনে। সৌমিত্রবাবু রাজি হন জীবনের পাতা খুলে দেখানোর ক্ষেত্রে। বাস্তবের জীবন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় অভিযানে, আর পর্দায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কান্না যেন মন ব্যাকুল করে দেয় আপামর দর্শকদের। সিনেমা এগোতে থাকে কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে।

‘যারা বই পড়ে না, তাদের আমার জীবন জানার দরকার নেই…’

পরিচালক সূত্র বেঁধে দিয়েছেন শুরুতেই। একে একে এসেছে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু, কফি হাউস, সুনীল-শক্তির সঙ্গে বন্ধুতা, প্রফুল্ল ও শিশির ভাদুড়ি, ছায়ানট। সশব্দেই রঙিন পর্দায় জানান দিয়েছে বামপন্থা, কংগ্রেস আমলে ট্রাম-খাদ্য-রেশন-শিক্ষক আন্দোলন এবং তার সঙ্গেই সেই আত্মোপলব্ধি, ‘Stage is the hell and we are mere devils there…’।

অনেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রে যিশু সেনগুপ্তকে দেখে অবাক হয়েছেন। ভুললে চলবে না, সৌমিত্রবাবু নিজেই যিশু সেনগুপ্তকে বেছে নিয়েছিলেন। আর এসেছেন সত্যজিৎ রায়, কিউয়ের মাধ্যমে। তবে অনাবশ্যক excellent বলা এবং প্রতিটি দৃশ্যেই সিগারেট বা চুরুট নিয়ে কথা বলার ফ্রেম একটু একঘেয়ে করে দিয়েছে। তারপর রূপকের মাধ্যমে এসেছে অনেক সিনেমা আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, যিনি উত্তমকুমারের চরিত্র অভিনয় করেছেন।

এই সিনেমায় কিছু উপেক্ষিত দিক উঠে এসেছে, যেখানে সৌমিত্র-উত্তম দ্বন্দ্ব রয়েছে আবার তার সঙ্গে কলাকুশলী হলমালিকদের সমস্যা আবার নায়িকাদের সঙ্গে ফেলুদার রসায়ন। তবে বিশেষ ভাবে নজর কেড়েছেন বাসবদত্তা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সহধর্মিণীর চরিত্রে। রবি ঘোষের চরিত্রে রুদ্রনীল ঘোষ ও সুচিত্রা সেনের চরিত্রে পাওলি দাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো।

তবে এই সিনেমার সম্পদ এক ও অদ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সিনেমা জুড়ে উনি অথচ অসম্ভব অনায়াস অভিনয়! ডকুমেন্টারির ধাঁচে ওঁর অনেক শটই ফিক্সড ফ্রেমে নেওয়া হলেও, ভীষণ সাবলীল। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরারোপ যথাযথ। পরিচালক পরমব্রত কি জিওকাকা, হাওয়াবদলের রেশ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন ক্যামেরার পিছনে? এই সিনেমা হয়তো তার উত্তর দেবে ঝেড়ে কেশে।

বাংলা সিনেমার ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে, ‘অভিযান’ নামেই একটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায় ১৯৬২ সালে যেখানে সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন ওয়াহিদা রহমান। তবে এই ‘অভিযান’ সত্যি যেন এক ঘূর্ণায়মান চক্রের মতো। ইংরেজিতে Swansong একটি শব্দ রয়েছে, যার সহজ বাংলা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। এই সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অবলীলায় দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, ‘অভিনয় ঠিক কাকে বলা হতো সোনালি প্রজন্মে!’

নতুন প্রজন্মের দর্শকদের জন্য এই (কিছুটা দীর্ঘায়িত) সিনেমায় রয়েছে সেই অমোঘ সত্য, ‘The tragedy of life is in what dies inside a man while he lives…’

পর্দার নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দিনের শেষে আপাদমস্তক বাঙালি ভদ্রলোক ছিলেন, যাকে জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে, ভুল-ত্রুটি-সাফল্যে বারবার জর্জরিত হতে হয়েছে। এখানেই অভিযানের সাফল্য আবার ব্যর্থতাও বটে!

For all the latest entertainment News Click Here 

Read original article here

Denial of responsibility! TechAI is an automatic aggregator around the global media. All the content are available free on Internet. We have just arranged it in one platform for educational purpose only. In each content, the hyperlink to the primary source is specified. All trademarks belong to their rightful owners, all materials to their authors. If you are the owner of the content and do not want us to publish your materials on our website, please contact us by email – [email protected]. The content will be deleted within 24 hours.