স্মৃতির যুদ্ধে ইন্দুবালা, বাল্যপ্রেমে মিশে গেল নকশী কাঁথার মাঠ, ফিরল মুক্তিযুদ্ধ
ইন্দুবালার দ্বিতীয় ভাগের পর্বগুলি যখন দেখা শেষ করলাম তখন দুচোখ জলে ভরে গিয়েছে। রাত তখন প্রায় আড়াইটে। কানে তখনও বেজে চলেছে ইন্দুবালা সিরিজের আবহ সঙ্গীত। চোখে ভাসছে ইন্দুবালার কলাপোতা গ্রামের ফেল আসা স্মৃতি, ইন্দুর বাল্যপ্রেম মণিরুল, আর ইন্দুবালার ‘স্মৃতির যুদ্ধ’। দুই ছেলেকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল ইন্দুবালা, সঙ্গী ছিল মাছওয়ালি লছমি। প্রেক্ষাগৃহের স্ক্রিনে তখন ফুটে উঠেছে নদীপাড়ের কাশবন, যেখানে দাঁড়িয়ে হীরু (অনুপকুমার)র সঙ্গে কুমুদিনীর সখ্যতা তৈরি হচ্ছে। এ যেন মণিরুলের সঙ্গে তারই প্রেমের গল্প। স্মৃতিতে ডুব দিল ইন্দুবালা। স্বপ্নভঙ্গ হল বোমার শব্দে। নাহ, ইন্দুবালাদের সিনেমা দেখা হল না, বাড়ি ফিরতে হল। কলকাতায় বসেই ইন্দু জানত পারল বাংলাদেশে চলা মুক্তিযুদ্ধের কথা। যে যুদ্ধে নাকি মণিরুলও জড়িয়ে পড়েছিল। এদিকে কলকাতাও তখন উত্তাল। নকশাল আন্দোলন, পুলিশের সঙ্গে নকশালদের সংঘর্ষে অগ্নিগর্ভ কলকাতা।
দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়ার পরও মণিরুলের জন্য অপেক্ষা করেছিল ইন্দুবালা। চিঠি এল মণিরুল আসবে, এল অলোক। নকশাল অলোকের হাত ধরেই ইন্দু জানতে পারল দু’দেশে যুদ্ধ চলেছে। কলাপোতা থেকে আসার পরই চারদেওয়ালের মধ্যেই বন্ধ ইন্দুবালা। এত যুদ্ধের কথা তার জানা নেই। অবুজ ইন্দুবালার প্রশ্ন, এপার-ওপার একসঙ্গে মিলে কেন তাঁরা যুদ্ধা করছেন না? অলোক তাঁকে বোঝালেন দুই যুদ্ধের পার্থক্য…। যদিও ইন্দুবালার কাছে যুদ্ধ বলতে শুধু ‘স্মৃতির যুদ্ধ’। সে যুদ্ধ মনে রাখার নাকি ভুলে যাওয়ার তা তাঁর জানা নেই। সারা জীবন ধরে সেই স্মৃতির যুদ্ধই করে গিয়েছে ইন্দুবালা। এ যুদ্ধে অবশ্য ইন্দুবালা কোনওকিছুই ভোলেনি, সযত্নে লালন করেছে সেই স্মৃতিদের।
Indubala Bhater Hotel Review part 1: পাখির জীবন ছেড়ে খাঁচাবন্দি, চোখের জলে ভেজে ইন্দুবালার স্মৃতিপট
‘স্মৃতি সততই সুখের’। ইন্দুর স্মৃতিতে অবশ্য সুখের থেকে দুঃখ-ই বেশি। তবে ইন্দু তাঁর সুখ খুঁজে ফিরেছে সেই সুখ-দুখের স্মৃতিগুলে আগলে রাখার মধ্যে। মণিরুলের স্মৃতি সে বাঁচিয়ে রেখেছিল, তাঁর বাঁশির সুর আর ‘নকশী কাঁথার মাঠ’আখ্যান কাব্য পাঠের মধ্য দিয়ে। সাজু-রুপাই-এর ভালোবাসা যেন ইন্দুবালা-মণিরুলের ভালোবাসার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মণিরুলকে হারালেও এসেছিল অলোক। নকশাল যুদ্ধ তাঁকেও কেড়ে নেয়। ইন্দুর অনুভূতি ‘মণিরুলদের হয়ত মরে যেতেই হয়, বারবার, কিংবা যাঁরা মরে যায় তাঁরাই মণিরুল। অলোক, রেয়াজ, কিংবা রুপাই, তারা আসলে মণিরুল’। নিজের জীবনে একের পর এক মানুষকে হারিয়ে ইন্দুবালা একা, ‘যদিও তাঁর অনুভূতি কেউ কি কখনও থেকেছে!’
স্মৃতি ছাড়াও ইন্দুবালার জীবনে বর্তমান তাঁর দুই ছেলে, দুই বউমা, নাতি-নাতনি সকলেই আছে। যদিও ইন্দু তাঁদের কিছুটা দূরেই সরিয়ে রাখে। ওয়েব সিরিজের শেষভাগে ইন্দুর কাছে ফিরেছে তাঁর দুই ছেলেও। তাঁদের পেয়ে ইন্দুকে যতটা না খুশি দেখিয়েছি, তার থেকেও বেশি খুশি তার একাকীত্বে। এই একাকীত্বকেই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে সে। বাড়ি ফিরে ছুটিতে মাকে নিয়ে বাংলাদেশ যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলে ইন্দুর বড় ছেলে। এমন প্রস্তাবে ইন্দু খুশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। শুরু হয় বাংলাদেশে ফেরার প্রস্তুতি। তবে ইন্দু কি শেষপর্যন্ত নিজের দেশে ফিরতে পেরেছিল? ছুঁয়ে দেখেছিল বহু বছর আগে ফেলে আসা কলাপোতা গ্রামকে? এসব কথা না হয় নাই বা বললাম। এগুলো আপনাদের দেখার জন্যই তোলা থাকল।
প্রথমভাগের মতো দ্বিতীয়ভাগেও কিশোরী, মধ্যবয়স্কা ও বৃদ্ধা ইন্দুবালা, জীবনের তিনস্তরে গল্প বুনেছেন পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য। যেভাবে তিনি তিনটি সময়কালকে একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছেন তা অনবদ্য। তিনটি সময়কাল থাকলেও দর্শককে একটা থেকে অপরটায় যেতে কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি। এটা দেবালয় পুরোটাই করেছেন নিখুঁত সৃজনশৈলীতে।
আর ‘ইন্দুবালা’কে দর্শকদের মনে গেঁথে দিতে সফল অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। এককথায় তিনি অনবদ্য। কোথাও বৃদ্ধা ইন্দুবালার ভূমিকায় শুভশ্রীকে দেখে মন খুঁত খুঁত করেনি। তবে প্রথমভাগের মতো দ্বিতীয়ভাগেও প্রস্থেটিক মেকআপ যেন বড় বেশি চড়া মনে হয়েছে। যদিও খুঁতটুকু অভিনয় দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। প্রথমভাগের থেকেও দ্বিতীয়ভাগেই বেশি দেখা গিয়েছে কিশোরী ইন্দুবালাকে। যে ভূমিকায় পারিজাত চৌধুরী অসামান্য। তাঁর বাঙাল ভাষার টানে বলা কথা, আর মণিরুল বলে সুর করে সেই ডাক এখনও যেন কানে বাজছে। পাশাপাশি রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায় (ইন্দুর ছোট ছেলে), স্নেহা চট্টোপাধ্যায় (লছমি), সুহোত্র মুখোপাধ্যায় (অলোক), দেবদত্ত রাহা (মণিরুল), দেপ্রতীম দাশগুপ্ত (ধনা) সকলের অভিনয়ই প্রশংসনীয়। আর অবশ্যই যাঁদের প্রশংসা না করলেই নয়, তাঁরা হলেন সিনেমাটোগ্রাফার রম্যদীপ। তিনিই আরও বেশি করে গল্পটি জীবন্ত করে তুলেছেন তাঁর অসামান্য ক্যামেরার কারিকুরিতে। সম্পদক সংলাপ ভৌমিকের সুন্দর মসৃণ সম্পাদনা ছাড়া এভাবে গল্পের বইয়ের মতো করে ইন্দুবালাকে আঁকা হয়ত সম্ভব হত না। আর সবথেকে বেশি মন ছুঁয়েছে ওয়েব সিরিজের গান। গানগুলির সুন্দর গল্পের প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত ব্যবহার। প্রতিটি গানই যেন ইন্দুবালা আর তাঁর জীবনের লড়াইয়ের গল্পকে আরও বেশি করে দর্শকদের মনে গেঁথে দিয়েছে।
For all the latest entertainment News Click Here