‘যৌবনকাল অবধি মা বাবাকে দস্তুরমতো চুমু খেতে দেখেছি – লুকিয়ে নয়’: কবীর সুমন
করোনার অতিমারীর সঙ্গে লড়াই করছে গোটা বিশ্ব, চারিদিকে মৃত্যু, মন খারাপ আর হতাশা। এর মাঝেই এক শীতের দিনে মনের ঝাঁপি খুললেন বর্ষীয়ান সংগীত শিল্পী কবীর সুমন। তাঁর গলার জাদুতে আজও মাতোয়ারা বাঙালি। তাঁর কন্ঠ-কলমে আজও ঝরে পড়ে বিপ্লব। সুরের জাদুকর আচমকাই ডুব দিয়েছেন অতীতের স্মৃতিতে। ভেসে বেড়াচ্ছেন মায়ের স্মৃতিতে। নিজের মা, উমা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে দীর্ঘ ফেসবুক পোস্ট লিখলেন কবীর সুমন।
আশির দশকে মায়ের সঙ্গে ওয়াংশিটনে গিয়েছিলেন কবীর সুমন। সেই ছবি আমচকা তাঁকে পাঠিয়েছে এক পরিচত, যা দেখে আবেগঘন বর্ষীয়ান শিল্পী। স্মৃতির সরণি বেয়ে তিনি ফিরেছেন চার দশক পুরোনো কোনও এক বিকালে। নিজের কলমের জাদুতে তাঁর মায়ের সঙ্গে আরও ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন অনুরাগীদের সঙ্গে।
কবীর সুমন লিখেছেন, ‘মায়ের সঙ্গে আমার ছবি খুব কম। এই ছবিটা কে যেন পাঠিয়েছেন আমায়। সেই কবে আমেরিকায় তোলা। ১৯৮০ সালে ভি ও এর চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মূর্খ তাই চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছিলাম। —- অসামান্য এক মহিলা ছিলেন আমার মা। সারাজীবন স্বাধীনচেতা। বেপরোয়া। কারুর তোয়াক্কা করেননি। জন্মস্বাধীন। অক্লান্ত পাঠক। বই আর বই। আমার ৭/৮ বছর বয়স থেকে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন। আমাকেও নিত্যজীবনে স্বাবলম্বনের পাঠ দিয়েছিলেন। মা মা” করিনি কখনও। — মার্ক্সিস্ট ছিলেন। সিপিআইএমের সমর্থক। তারপর নকশালপন্থী। ওদিকে জ্যোতি বসুর কাণ্ডজ্ঞানভিত্তিক সোজাসাপ্টা কথাবার্তার ভক্ত’।
গানের প্রতি বরাবর ঝোঁক ছিল তাঁর মায়ের। গায়ক যোগ করেন, ‘সুগায়িকা ছিলেন। চারের দশকে বেতারে তো গাইতেনই, গ্রামোফোন রেকর্ডও ছিল। — বাবা আকাশবাণীতে কাজি নজরুল ইসলামের সুপারিশে চাকরি নেওয়ার পর বাবা মা দুজনেই বেতারে গান গাওয়া বন্ধ করে দেন নীতিগত কারণে। মা অভিনয়ও করতেন। রক্তকরবীর এক বিখ্যাত শো’তে মা ছিলেন নন্দিনী আর দেবব্রত বিশ্বাস বিশু পাগল। নিউ এম্পায়ারে মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমার ধারণা, দুজনের মধ্যে কিঞ্চিৎ প্রণয়ও ছিল। প্রথমবার চীনে গান গাইতে গিয়ে (মনে হয় যেন গত জন্মের কথা) দেবব্রতবাবু মার জন্য এক রাশ উপহার নিয়ে এসেছিলেন। কাঁচের তৈরি কী চমৎকার সব ক্ষুদে পুতুল। দেবব্রত বিশ্বাস এলআইসি’র এজেন্ট ছিলেন। তাঁর প্রথম দুই পলিসি নিয়েছিলেন মা আর বাবা। মা স্বাভাবিকভাবে, খোলাখুলি তাঁর পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে ডেট করতেন সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমার যৌবনকাল পেরিয়ে। আমার বাবার তাতে কোনও অসুবিধে দেখিনি। ছেলেবেলা থেকে যৌবনকাল অবধি মা বাবাকে দস্তুরমতো চুমু খেতে দেখেছি – লুকিয়ে নয়। আমার সামনেই তাঁরা আদর করতেন। – আমি আমার নাম পাল্টানোর পর অনেকে আমার মাকে ফোন করে বলতেন, ‘আপনার ছেলে তো মুসলমান হয়ে গেল!’ আমার মা তাঁদের বলতেন, ‘আমার ছেলে বলেই তো হলো, নয়তো কি তোমার বাবা হবেন?’ – ব্রিটিশ আমলে মার সঙ্গে এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান যুবকের আলাপ ও মন দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল। বিয়ের কথাও হয়েছিল। সে আমলে সিভিল ম্যারেজ ছিল না। আমার মা আমায় বলেছিলেন সেই যুবকটির জন্য মার মুসলমান হতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু মাঝপথে সুগায়ক ও সুদর্শন সুধীন্দ্রনাথ ব্যুহে ঢুকে পড়ায় সেই ব্যারিস্টার ভদ্রলোকের কপাল পুড়ল’।
সবশেষে কবীর সুমন যোগ করেন, শীতের দুপুরে বারান্দায় রোদ পোহাতে পোহাতে এই সব কথা লিখলেন তিনি। এখনও মায়ের উপস্থিতি সবসময় অনুভব করেন তিনি, শুধু দেখাটুকুই যা পান না। সুরের আনাগোনায় তাঁর মায়ের উপস্থিতি, সেই উপস্থিতি শাশ্বত। তিনি সবশেষে লিখেছেন, ‘মা মাঝেমাঝে আসেন। দেখতে পাই না। কিন্তু বুঝতে পারি তিনি এসেছেন। গান শুনতে চান। পাশের বাড়ির তিন তলায় একটি ছেলে বাঁশি শিখছেন। তাঁর রেয়াজের সূত্রে এ পাড়ায় বাঁশির সুর ঘুরে বেড়ায়। জয় সুর’।
For all the latest entertainment News Click Here