ম্যাকবেথের ছাঁচে নারীকেন্দ্রীক ছবি, ‘মায়া’ মিথিলার অঙ্গুলিহেলনে গল্পের পথ চলা
শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ পড়েছেন? স্কটল্যান্ডের সেই রাজা ডানকান, তাঁর রানি, রাজার পরম বিশ্বস্ত সেনাপ্রধান ম্যাকবেথের গল্প অনেকেরই জানা। তিন ডাইনির ভবিষ্যৎবাণী ছিল একদিন ম্যাকবেথই হবে স্কটল্যান্ডের রাজা। তারপর একদিন পরম বিশ্বস্ত সেই
ম্যাকবেথের হাতেই কিনা মৃত্যু হল ডানকানের। সিংহাসনে বলেছিল ম্যাকবেথ। তবে তাঁরও পরিণতি ভালো হয়নি।
ভাবছেন হঠাৎ ‘ম্যাকবেথ’-এর গল্প কেন শোনাচ্ছি! কারণ, ১৮৪৮-এর সেই ‘ম্য়াকবেথ’-এর গল্পই ‘মায়া’র মোড়কে উঠে এসেছে। নাহ, রাজর্ষি দে-র এই ছবিকে শেক্সপিয়রের নাটকের সরাসরি রূপান্তর বলা যাবে না। তবে ছাঁচটা একই। ‘মায়া’-তেও রাজা আছে, রানিও আছে, আছে বিশ্বস্ত কর্মচারীর হাতে রাজার পরাজিত হওয়ার গল্প। রয়েছে সম্পর্কের জটিলতা, রাজনীতি, বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতারিত হওয়ার গল্প। আবার এই গল্পের আধারেই উঠে এসেছে মহিলাদের উপর পুরুষসমাজের চিরকালীন অত্যাচারের কাহিনী। পুরুষের নির্লজ্জ কামুকতার কাছে নারী অসহায়তার গল্প আবার প্রতিবাদী হয়ে ওঠার কথা। অর্থাৎ শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথকে নারী কেন্দ্রিক ছবির বুননে বুনেছেন পরিচালক রাজর্ষি দে।
‘মায়া’র গল্পে রাজা ‘ডানকান’ বলা যায় দরবার সিং শর্মা ওরফে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে। স্ত্রীর অবর্তমানে তাঁর তিন রক্ষিতা পরমিতা (কনীনিকা), তনুশ্রী (মৃণালিনী) এবং সামিয়া (রিচা)। এদের সকলেই দরকার নায়িকা বানানোর লোভে বেঁথে ফেলে। আছে দরবারের লম্পট ছেলে ময়ঙ্ক (রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়), যাঁর সঙ্গে আবার তাঁর বাবার বিস্তর ঝামেলা, বাবা কামুকতা থেকে বাদ পড়েননি ময়ঙ্কের স্ত্রী রেশমিও (সুদীপ্তা চক্রবর্তী)। রেশমির মেয়ে বুবু (রণিতা দাস)। আর দরবার সিং-এর সেই বিশ্বস্ত কর্মচারী হলেন মাইকেল ( গৌরব চক্রবর্তী)। গল্পের জটিলতায় ‘লেডি ম্যাকবেথ’র বেশে ধরা দিয়েছেন তনুশ্রী। আর তাঁর সাকরেদ হয়েছেন অভিনেত্রী সায়ন্তনী গুহ ঠাকুরতা। ছবিতে ম্যাকবেথের সেই ‘ডাইনি’ এখানে ‘মায়া’ (রাফিয়াত রশিদ মিথিলা)। সেই মায়ার ভবিষ্যৎবাণীর উপরই ছবির গল্প এগোতে থাকে। এদিকে আবার মায়ার প্রথম জীবনে সঙ্গে জুড়ে রয়েছে তাঁর ভালোবাসার মানুষ আলি (অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়)। ছবিতে রয়েছে গৌরব চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা কুমার, ইশান মজুমদার।
আরও পড়ুন-পাখির জীবন ছেড়ে খাঁচাবন্দি, চোখের জলে ভেজে ইন্দুবালার স্মৃতিপট
আরও পড়ন-ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মুখোমুখি, অপরাধীদের ‘মগজধোলাই’ পরমব্রতর
আরও পড়ুন-ভারতীয় সিনেমার স্বর্ণযুগের গল্প বলে ‘জুবিলি’, ছাপোষা বিনোদ হন তারকা ‘মদন কুমার’
আরও পড়ুন-কাবেরী অন্তর্ধান রিভিউ: রাজনীতির কুয়াশায় মিশে যাওয়া এক প্রেমের গল্প বলে এই ছবি
আবার এই ‘মায়া’র গল্পেই মিশে রয়েছে একাধিক মহিলার জীবনের গল্প, প্রতিটি প্লটই বেশ কঠিন। তবে তাঁদের ধীরে ধীরে নিজের মুন্সিয়ানায় একই সুতোই গেঁথেছেন পরিচালক রাজর্ষি দে। ২ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের ছবি, যেটা যেকোনও ফিচার ফিল্মের তুলনায় বেশ বড়। তবে এই সময়ের মধ্যেই চিত্রনাট্যের কারিকুরিতে অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে কলকাঠি নেড়েছেন পরিচালক। একদিকে রাজনীতি, ক্ষমতা দখল ও সম্পর্কের জটিলতার গল্প যেমন আছে, তেমনই এখানে প্রতিশোধের আগুনে পুড়েছে রাজর্ষি দে-র ‘মায়া’। এই গল্পে নানান ওঠাপড়া রয়েছে। আবার ছবির শেষের দিকে চরিত্রদের উপস্থাপনাতে খানিক নাটকের ঢংও রয়েছে। ঠিক যেমন নাটকের শেষে মঞ্চে চরিত্রটা একে একে উঠে আসে। বাংলা ছবিতে এধরনের উপস্থাপনা খুব কমই দেখেছেন বাংলার দর্শক। যদিও ছবির অধিংকাংশ চরিত্রই এখানে অবাঙালি, বহু ডায়ালগই রয়েছে হিন্দিতে। এখানেও গল্প বলার কায়দায় বাংলার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। মূল চরিত্রগুলির অনেকেই এখানে অবাঙালি। তাঁদের সাজ-সজ্জা বেশভূষাতেও হিন্দি বলয়ের ছাপ রেখেছেন পরিচালক। হয়তবা গল্পে যে জটিলতা, রাজনীতি দেখানো হয়েছে, সেটা বাংলা ও বাঙালির প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ঠিক খাপ খায়না বলেই এই কৌশল বেছে নিয়েছেন পরিচালক।
তারকাখচিত এই ছবিতে অভিনেতারা প্রত্যেকেই অসাধারণ। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে এর আগে এমন কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখা গিয়েছে বলে মনে পড়ে না। এই ছবিতে তাঁর খল চরিত্র হলেও তিনিই আসল হিরো। এছাড়া বাকি দুই গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ চরিত্রে জমিয়ে, সবটা উজাড় করে অভিনয় করেছেন রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকি মহিলা চরিত্রগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি নজর যে দু’জন কেড়েছেন, তাঁরা হলেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী ও রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। অভিজ্ঞ, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সুদীপ্তা চক্রবর্তীর অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। অবাঙালি চরিত্রেও তিনি ভীষণ সাবলীল, কোথাও বোঝার উপায় নেই যে তিনি বাঙালি। আর ‘ডাইনি’ ‘মায়া’ যাঁর অঙ্গুলিহেলনে পুরো গল্পের পথচলা সেই মিথিলা তাঁর ডেবিউ ছবিতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি জাত অভিনেত্রী। তাঁর ধীরে স্বরে কথা বলা, বাংলাদেশের মেয়ে হয়েও সাবলীল হিন্দি বলা, নজর কাড়ে। তবে সবথেকে বেশি মন ছুঁয়েছে মিথিলার চোখের ভাষা, অভিব্যক্তি। ডায়ালগের প্রয়োজন নেই চোখ দিয়েই তিনি অনেকটা অভিনয় করে ফেলেছেন।চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর বেশভূষা, চুল নজর কাড়ে বৈকি।
এছাড়া নিজ নিজ চরিত্রে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, গৌরব চট্টোপাধ্যায় রণিতা, তনুশ্রী, কনীনিকা, সায়ন্তনী সকলেই সাবলীল অভিনয় করেছেন। তবে যেটা বিশেষ মনে ধরেনি, তা হল ছবির গান ও আবাহসঙ্গীত। আর ছবিটা দৈর্ঘ্য হয়ত অনেক দর্শকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে পারে। সেটা হয়তবা একটু কম করা গেলে ভালো হত। তবে তারপরেও গল্প বলার আঙ্গিকে ‘মায়া’ বাঁধনে দর্শককে বেঁধে ফেলার অনেক রসদই রয়েছে এই ছবিতি।
For all the latest entertainment News Click Here