বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম যদি বাংলাভাষাকে না ভালোবাসে, তার দায় আমাদের: বাঁধন
আজমেরী হক বাঁধন, মডেল, অভিনেত্রী, চিকিৎসক, বাংলাদেশ
মাতৃভাষা তো মায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে যে সে তার মায়ের ভাষায় কথা বলবে, মনের ভাব প্রকাশ করবে। গোটা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে-ই তাঁদের মাতৃভাষা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের বাংলাদেশের মানুষের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আবেগের, কারণ আমাদের থেকে একদিন তো মায়ের ভাষাকেই ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, আর ভাষা শহিদরা মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। তাই মাতৃভাষা নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মানুষের থেকেও আমাদের আবেগটা হয়ত একটু বেশি। এই বিশেষ দিনে আমরা ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাই। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন যদিও শুধু বাংলা ভাষা নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
২১ ফেব্রুয়ারি, এই দিনটির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্যদের মতোই আমারও ছোটবেলার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। ছোটতে বই- এ পড়েছি ভাষা আন্দোলনের কথা, ভাষা শহিদদের কথা, বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা। ছোটবেলায় আমারা এই দিনে শহিদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আর এখন আমার ১১ বছরের মেয়েও সেই প্রথা পালন কর চলেছে। আমাদের এখানে স্কুলগুলিতে এই প্রথা প্রত্যেক বছরই পালন করা হয়। আমার মেয়ে বা বাংলাদেশের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ছোট থেকেই এই বিষয়টা জেনেই বড় হয়। ওদের বড় হওয়ার সঙ্গেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জড়িয়ে যায়।
আসলে ভাষা দিবস নিয়ে আবেগটা নিজের ভিতরে ধারণ করার বিষয়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই দিনটি নিয়ে কতটা আবেগ থাকবে, সেটা কিছুটা স্কুল আবার কিছুটা আমরা যাঁরা তাঁদের পরিবারের অংশ, তাঁদের উপর নির্ভর করছে। আমরা কীভাবে তাঁদের সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের কথা জানাচ্ছি। ভাষা দিবস যে বহু ভাষা শহিদের রক্তে রাঙা, সেটা এখনকার প্রজন্মও জেনেই বড় হচ্ছে। এবার কীভাবে তাঁরা সেটা তাঁদের মধ্যে বহন করে চলবে, এটা আজ অবশ্যই একটা চ্যালেঞ্জ। তবে প্রত্যেক পরিবার তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মর্মে সেটা ঢুকিয়ে দিতে পারলে, নিশ্চয় ভবিষ্যতেও এই আবেগটা বাংলেদেশে বেঁচে থাকবে।
আমার মনে হয়, প্রতিটা মানুষ যদি নিজেকে ভালোবাসেন, মাতৃভাষাকে ভালোবাসেন, দেশকে ভালোবাসেন, সেই জায়গায় আলাদা করে দায়িত্ব পালন না করলেও এই ভাষা এহং মায়ের ভাষা নিয়ে এই আবেগটা বেঁচে থাকবে। তবে যুগের সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন হয়। আদিতে যে বাংলা ছিল, কিংবা কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমরা যে বাংলায় কথা বলেছি, সেটা হয়ত আজ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। যে ভাষাতেই কথা বলুন, সেই ভাষার প্রতি সম্মান বোধ থাকা জরুরি। আজকাল অনেকেই ইংরাজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছেন, পুরো পৃথিবীতে ইংরাজি সর্বজনীন ভাষা, তাই হয়ত ইংরাজি সবভাষার উপরই প্রভাব ফেলছে। আর সেটাই স্বাভাবিক। তবে পরিবারের তরফে যদি এখন প্রজন্মের উপর নজর রাখলে কোনও সমস্যা হবে না। আগামী প্রজন্মকে এটাই শেখাতে হবে তাঁরা যেন নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে লজ্জা না পান। তবে আজ খারাপ লাগে যখন দেখি বাঙালি হয়েও কেউ নিজের ছেলেমেয়ে বাংলা না জেনে অন্যভাষা রপ্ত করেছে বলে গর্ব করেন। এটা যে গর্বের নয়, সেই বোধটাই তাঁদের নেই। নিজের ভাষাকে অস্বীকার করার অর্থ নিজের সত্ত্বাকে অস্বীকার করা। এটা আসলে হীনমন্যতা, এর জন্য নতুন প্রজন্মের থেকেও আমাদের প্রজন্মের কিছু লোকজনকেই দোষ দেব। আমি যদি আমার সন্তানকে বলি, ‘তুমি তোমাকে ভালোবাসবা, দেশকে ভালোবাসবা, মাকে ভালোবাসবা, মাতৃভাষাকেও ভালোবাসবা, সঙ্গে তুমি নানা রকমের নানা দেশের ভাষা শিখতেই পারো, কিন্তু নিজের ভাষাকে অস্বীকার করে নয়। নিজের ভাষাকে অস্বীকার করার অর্থ নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। এটা একটা বড় ক্ষতির পথে হাঁটা, নিজেকে বিকশিত করার পথে এটাই একদিন বড় একটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে…।
বাঁধনের সাক্ষাৎকারের অনুলিখন
For all the latest entertainment News Click Here