পুরুষতান্ত্রিকতার গালে সপাট চড়! মায়ের লড়াইয়ের গল্পে রানির চোখ দিয়ে কাঁদল দর্শক

সালটা ২০১১, স্বামী অনুরূপের হাত ধরে দেশ ছেড়ে সুদূর নরওয়েতে গিয়ে সংসার পেতেছিলেন সাগরিকা ভট্টাচার্য। সেখানে তাঁদের কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে দুই সন্তান, অভিজ্ঞান ও ঐশ্বর্য। তাঁদের নিয়েই দিব্যি কাটছিল জীবন। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। দুই সন্তানকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় ওঁরা। অভিযোগ, সাগরিকা ও তাঁর স্বামী নাকি তাঁদের ছেলেমেয়েদের ঠিকমত দেখাশোনা করতে পারছেন না। বাচ্চাদের তাঁরা নিজেদের কাছে নিয়ে ঘুমোন, হাতে করে খাবার খাওয়ান, নজর না লাগে সেজন্য মাথায় লাগান কাজলের টিকা! সাংস্কৃতিক এই বৈষম্যতে নরওয়ে সরকারের প্রতিনিধিদের মনে হয় শিশুদের দেখাশোনা ঠিক মতো করতে পারছে না ভট্টাচার্য পরিবার। তারপর সে এক দীর্ঘ লড়াই। বহু কষ্টে সাগরিকা তাঁর সন্তানদের ফিরে পান। তখন তাঁর সেই লড়াই সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল ঠিকই, তবে এতটাও মর্মস্পর্শী হয়ে হয়ত ছড়িয়ে পড়েনি। গোটা একটা দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে সাগরিকার সেই লড়াইকে এবার সকলের সামনে আনলেন রানি মুখোপাধ্যায়। সৌজন্যে ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’।

ছবির প্রয়োজনে কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিতে হলেও মূলত সাগরিকার ভট্টাচার্যের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সত্যি ঘটনার উপর এই ছবি বানিয়েছেন পরিচালক অসীমা ছিব্বর। তাই সিনেমা দেখতে যাওয়ার আগে থেকেই গল্পের পরিণতি মোটামুটি দর্শকদের জানা। ছবিতে গল্প বলার থেকেও সেটিকে মর্মস্পর্শী করে তোলাই ছিল পরিচালকের মূল চ্যালেঞ্জ। আর পরিচালকের হয়ে সেই কাজটা করলেন রানি। দর্শকরা দেখলেন এক মায়ের বুক ফাটা কান্না, দেখলেন সংস্কৃতির বৈষম্যে বিদেশে গিয়ে কতটা মূল্য চোকাতে হতে পারে একজন মাকে। গোটা ছবি আবর্তিত হল রানিকে ঘিরেই। আর তাতে রানির মতোই রাজ্যত্ব করলেন অভিনেত্রী। তিনি যেভাবে দেখালেন, যেভাবে চালনা করলেন দর্শকরাও সেভাবেই দেখলেন, চালিত হলেন। রানি হাসলেন, ছোট্ট দুই সন্তানদের সঙ্গে খেললেন, খাওয়ালেন, আবার তাঁদের আচমকা হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদলেন, পরভূমের আজব নিয়মে বিস্মিত হলেন, রাগ প্রকাশ করলেন, কখনও আবার নিরবেই কেঁদে চললেন। তাঁর অনুভূতি স্পর্শ করল দর্শকদেরও। নিজের অজান্তেই বহু দর্শকের চোখের কোণা দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ল।

আরও পড়ুন-মায়ের বুক থেকে কেড়ে নেওয়া হল সন্তানকে, সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রানি!

আরও পড়ুন-পাখির জীবন ছেড়ে খাঁচাবন্দি, চোখের জলে ভেজে ইন্দুবালার স্মৃতিপট

<p>‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ ছবিতে দেবিকার চরিত্রে রানি মুখোপাধ্যায়</p>

‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ ছবিতে দেবিকার চরিত্রে রানি মুখোপাধ্যায়

তবে শুধু মায়ের লড়াই নয়, এই ছবিতে পিতৃতন্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধেও সরব রানি। ছেলেরা রোজগার করবেন, আর মহিলারা ঘর সামলাবেন, কিন্ত পুরুষরাও যদি মহিলাদের পাশে দাঁড়িয়ে সংসার সামলাতে সাহায্য করেন তাহলে ক্ষতি কি? অন্যায়-ই বা কি? ছবির গল্পে সে প্রশ্নও তোলেন ‘দেবিকা’ ওরফে রানি। উঠে আসে গার্হস্থ্য হিংসার কথাও। ‘আমার বউ আমি মারতেই পারি’, স্বামীর এমন পুরুষতান্ত্রিক, ঘৃণ্য, পাশবিক ভাবনায় সপাটে চড় কষিয়েছেন রানি। ভালোবাসার খাতিরে প্রথমটা সহ্য করলেও সন্তান হারানোর পরই আসলে দেবিকা বুঝতে পারেন, তিনি কতটা একা? তাই শুধুই মার না খেয়ে স্বামী মিস্টার অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জির গালে তিনিও চড় কষিয়েছেন। যা দেখে হলের মধ্যে অজান্তে হাততালি দিয়ে উঠেছেন দর্শকরা। একা হয়ে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরও হার মানেননি ‘দেবিকা’, দেশে এবং দেশের বাইরে সর্বত্র তিনি লড়েছেন, তাঁর অদম্য মানসিকতার হাত ধরে শেষপর্যন্ত জিতে যাওয়ার আশা জিইয়ে রেখেছিলেন দর্শকরা।

 ‘দেবিকা’ জিতেছেন, তাঁর সেই জয়ের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে দর্শকদের মধ্যেও। অর্থাৎ এক ‘মা’-এর সেই লড়াইয়ের কথা দর্শকদের মনে গেঁথে দিয়ে সফল অভিনেত্রী রানি মুখোপাধ্যায়। এ ছবি যেন শুধুই তাঁর। একাই ঘাড়ে করে ছবিকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর অভিনয় দক্ষতা নিয়ে তাই নতুন করে কথা বলাটাই বোকামো। এদিকে প্রবাসী বাঙালি পরিবারকে ঘিরে গল্প আবর্তিত হওয়ায় বাংলা ভাষাটা এসেই যায়। সেক্ষেত্রেও নিজের মাতৃ ভাষাটা স্বচ্ছন্দেই বলেছেন মুম্বইয়ে বড় হওয়া রানি। উচ্চারণে কোথাও সেভাবে মনে হয়নি হিন্দির টান আছে। বরং হিন্দি ডায়ালগগুলি ছাপোষা বাঙালি মহিলাদের মতো গোল গোল করে উচ্চারণ করেছেন, ভাঙা ভাঙা, অল্পবিস্তর ইংরাজিও বলেছেন। যা চরিত্রটিকে অনেকবেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।

আরও পড়ুন-‘যশ কাকুর মৃত্যুর পর’, মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে নাড়িয়ে দিয়েছে আদিত্যকে?

আরও পড়ুন-কাবেরী অন্তর্ধান রিভিউ: রাজনীতির কুয়াশায় মিশে যাওয়া এক প্রেমের গল্প বলে এই ছবি

<p>‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ ছবিতে রানি ও অনির্বাণ</p>

‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ ছবিতে রানি ও অনির্বাণ

গোটা ছবির চিত্রনাট্যও টানটান, কোথাও কোনওকিছু অবান্তরভাবে দেখানো হয়েছে বলে মনে হয়নি। ছবির অন্যান্য অভিনেতাদের কথায় সর্বপ্রথম বলতে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কথা। চিত্রনাট্য অনুযায়ী এখানে বিশেষকিছু তাঁর করে দেখানোর ছিল না, তবে অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জির চরিত্রে রানিকে তিনি যোগ্য সঙ্গত করেছেন। ছোট্ট চরিত্র হলেও নরওয়ে সরকারের প্রতিনিধি, আইনজীবী হিসাবে জিম সর্বের অভিনয় সবকিছুর মধ্যে আলাদা করে নজর কেড়েছে। দেবিকার বাবার ভূমিকায় অভিনেতা বোধিসত্ত্ব মজুমদার, মায়ের ভূমিকায় চৈতালী দাশগুপ্ত, শাশুড়ির ভূমিকায় মিঠু চক্রবর্তী ও দেওরের ভূমিকায় সৌম্য মুখোপাধ্যায় রানিকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন। তবে এরপরেও চিত্রনাট্যের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে একটু মন খুঁত খুঁত রয়েই যায়। মনে হয়েছে রানি ছাড়াও ছবির অন্যন্য চরিত্রগুলিকে আরও একটু গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরলে গল্পটি আরও বেশি সুন্দরভাবে ফুটে উঠত। খটকা লাগে, এত সহজেই কি কাউকে মানসিকভাবে সুস্থ নয় বলে কোনও সরকারের তরফে ঘোষণা করা যায়? আবার চ্যাটার্জি বাড়িতে যখন ৫ মাসের শিশুর দেখভাল ঠিকমতো হচ্ছে কিনা দেখতে যখন প্রিতিনিধি দল আসে, তখন তাঁদের অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট ছিল যে ওঁরা তো শিশুটিকে নিয়ে যেতেই এসেছে। এমনই ছোটছোট কিছু বিষয় নিয়ে খটকা থাকলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে মায়ের বুকফাটা কান্না। আর শুরু থেকে শেষপর্যন্ত শুধু মুগ্ধ করেছেন রানি মুখোপাধ্যায়। সড়াইয়ে জিতেছেন মা দেবিকা, আর অভিনয়ে মন জিতেছেন রানি।

 

For all the latest entertainment News Click Here 

Read original article here

Denial of responsibility! TechAI is an automatic aggregator around the global media. All the content are available free on Internet. We have just arranged it in one platform for educational purpose only. In each content, the hyperlink to the primary source is specified. All trademarks belong to their rightful owners, all materials to their authors. If you are the owner of the content and do not want us to publish your materials on our website, please contact us by email – [email protected]. The content will be deleted within 24 hours.