চুয়াত্তরে চলে গেলেন ‘বঙ্গবালা’ শাঁওলি মিত্র, বাংলা রঙ্গমঞ্চে একটা যুগের অবসান
রবিবার নীরবে চলে গেলেন বাংলা থিয়েটারের ‘নাথবতী অনাথবৎ’। বাবার মতোই শম্ভু-মিত্র কন্যার ইচ্ছা ছিল তাঁকে যেন ‘ফুলভারে’ বিদায় না জানানো হয়। তাই শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার পরই শাঁওলি মিত্রের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে এনেছেন প্রিয়জনেরা।
বাংলা রঙ্গমঞ্চের দুই দাপুটে ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের একমাত্র কন্যা শাঁওলি মিত্র। ১৯৪৮ সালে সদ্য স্বাধীন ভারতে জন্ম হয়েছিল তাঁর। অভিনয় তাঁর রক্তে। ছোট থেকেই থিয়েটারের জগতেই মানুষ তিনি, অভিনয় ছিল তাঁর প্যাশন। নাটক নিয়েই উচ্চশিক্ষা শাঁওলি দেবীর। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক নিয়ে স্নাতোকত্তোর ডিগ্রি লাভ করেন।
শম্ভু মিত্রের কন্যা খুব ছোট বয়স থেকেই সাবলীল মঞ্চাভিনয়ে। প্রথমের দিকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে ‘পঞ্চম বৈদিক’ নামে নিজস্ব নাটকের দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই নাট্যব্যক্তিত্ব। সেই শুরু, এরপর একে একে ‘নাথবতী অনাথবত্’, ‘একটি রাজনৈতিক হত্যা’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘কথা অমৃতসমান’-এর মতো বহুল জনপ্রিয় নাটক উপহার দিয়েছেন শাঁওলি মিত্র।
বাংলা রঙ্গমঞ্চের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন শাঁওলি দেবী। থিয়েটার অন্ত প্রাণ এই ব্যক্তিত্ব আজীবন উজাড় করে দিয়েছেন বাংলা থিয়েটারের জন্য। অভিনয় জীবনের শুরুতে তিনি কাজ করেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। ‘যুক্তি, তক্কো আর গল্প’ ছবিতে তরুণী ‘বঙ্গবালা’ হয়ে ধরা দিয়েছিলেন তিনি। বুঝিয়ে ছিলেন রুপোলি পর্দাতেও কতটা ম্যাজিক্যাল তিনি। কিন্তু থিয়েটার নিবেদিতপ্রাণ শাঁওলি মিত্র সেইভাবে সিনেমার জগতে কাজ করেননি। কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা বোধহয় তিনি জানেন!
অভিনেত্রীর পাশাপাশি লেখিকা হিসাবেও যথেষ্ট নামডাক ছিল তাঁর। ‘গণনাট্য, নবনাট্য, সৎনাট্য ও শম্ভু মিত্র’তে বাবার অভিনয় জীবনের কথা লিখেছেন তিনি। বঙ্গীয় আকাদেমির অভিধানের প্রসারে কাজ করেছেন তিনি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে করেছেন একাধিক মূল্যবান কাজ।
১৯৯১ সালে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ বইটির জন্য আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন শাঁওলি মিত্র। দীর্ঘ কর্মজীবনে অজস্র স্বীকৃতি এসেছে তাঁর ঝুলিতে। ২০০৩ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, ২০০৯ সালে ভারত সরকার এই নাট্য ব্যক্তিত্বকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে। মমতা সরকার ২০১৩ সালে বঙ্গ বিভূষণ খেতাব দেয় তাঁকে।
তাঁর কন্ঠের জাদুতে বুঁদ বাঙালি, রেডিও-তে বহু শ্রুতিনাটক উপহার দিয়েছেন তিনি। শেষজীবনে শাঁওলি মিত্রের লেখা একাঙ্ক নাটক ‘সীতা’ মুুগ্ধ করেছিল নাট্যপ্রেমীদের।
আজীবন সমাজের শোষিত, অবহেলিত মানুষদের লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন শাঁওলি মিত্র। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম মুখ তিনি। রাজনৈতিক মঞ্চে দেখা মিললেও সরসারি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হননি তিনি। মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুর পর ‘বাংলা আকাদেমি’র দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ২০১৮ সালের শুরুতে পদ থেকে ইস্তফা দিলেও মাস কয়েকের মধ্যেই তিনি ফিরে আসেন, আমৃত্যু এই দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
রবিবার দুপুরে সব দায়িত্ব থেকে ছুটি নিলেন শাঁওলি মিত্র। জীবনের মঞ্চ থেকে চুপিসাড়ে বিদায় নিলেন শম্ভু মিত্র-কন্যা। খসে পড়ল বাংলা নাট্যজগতের আরও এক তারা। শেষ হল বাংলার রঙ্গমঞ্চের একটা যুগ।
For all the latest entertainment News Click Here