কাবেরী অন্তর্ধান রিভিউ: রাজনীতির কুয়াশায় মিশে যাওয়া এক প্রেমের গল্প বলে এই ছবি
‘তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি নকশালবাড়ি’। ১৯৬৭-র সেই স্লোগান হয়ত আজ আর শোনা যায় না। তবে নকশাল আন্দোলের ইতিহাসে আজও জ্বলজ্বল করছে ১৯৬৭-র সেই ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’। যে আন্দোলন থেকেই থেকে নকশাল আন্দোলনের সূচনা, পরে যা ধীরে ধীরে গোটা রাজ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও। সেই নকশাল আন্দোলন, পরবর্তী সময় ১৯৭৫-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থা ঘোষণা, সেই প্রেক্ষাপটেই ছবির শুরু, তারপর টুক করে একটা অন্য গল্প ঢুকে পড়া, যার নাম ‘কাবেরী অন্তর্ধান’।
যদিও ‘কাবেরী অন্তর্ধান’-এর গল্পের সঙ্গেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে নকশাল আন্দোলের কথা, নকশালদের কথা। ‘হাতিমারা’ নামে একটি জায়গা ঘিরেই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের -এই ছবির গল্প। ছবির দৃশ্যই বলে দেয় ‘হাতিমারা’কে উত্তরবঙ্গের কোনও একটি জায়গা হিসাবেই দেখানো হয়েছে। যদিও বর্তমানে পুরুলিয়াতেও ‘হাতিমারা’ বলে একটি গ্রাম রয়েছে। সে যাই হোক…।
ছবির শুরুতে পুলিস অফিসার মৃণ্ময় ঘোষের (কৌশিক সেন) মৃত্যুর তদন্তে হাতিমারা আসেন পুলিস আধিকারিক প্রীতম সিং (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) , সঙ্গে জুড়ে যায় মৃণ্ময় ঘোষের বোন কাবেরী (শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়)এর অন্তর্ধানের তদন্তও। ঘটনাদুটি যে একই দিনে ঘটেছে। দীর্ঘ একবছর পরও যার কোনও কিনারা হয়নি। এরপর ধীরে ধীরে গল্পের সঙ্গে জুড়ে যায় এক একটি চরিত্র মৃত পুলিস আধিকারিকের স্ত্রী নয়নতারা ঘোষ (চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়), চিত্রশিল্পী অর্ঘকমল (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়), নিখোঁজ কাবেরীর স্বামী (অম্বরিশ ভট্টাচার্য)। গোয়েন্দা (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়) অর্ঘ্যকমলের ভাই অর্ক (ইন্দ্রাশিস রায়)। তদন্তের শুরুতে বারবারই সন্দেহ গিয়ে পড়ে চিত্রশিল্পী অর্ঘ্যকমল অর্থৎ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের দিকে। মনে হতে থাকে যত কাণ্ডের মূলে আসেলে প্রসেনজিৎ। সত্যিই কি তিনি দোষী? নাকি অন্য কোনও রহস্য রয়েছে? ১ বছর আগে ঘটে যাওয়া খুন ও অন্তর্ধানের ঘটনার কাসুন্দি ঘাঁটতে ঘাঁটতে ছবির গল্প এগোয় অতীত ও বর্তমানের সমান্তরালে। অতীতের দৃশ্য, বর্তমানের ঘটনা সবকিছু মিলেমিশে গিয়ে রহস্যের জট যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে। এভাবেই নিজস্বভঙ্গী ‘রাজনীতির কুয়াশা’য় মিশে যাওয়া একটি প্রেমের গল্পও বলে ফেলেন পরিচালক। যদিও আবার খুববেশি যে বাণিজ্যিক ছবির মতো গদগদ প্রেমের বাড়াবাড়ি এখানে নেই।
কাবেরী অন্তর্ধানের শুরু থেকে শেষ কোনও জায়গাতেই ছবিটি একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি। শুরু থেকে টানটান উত্তেজনা, রহস্যের গন্ধ খুঁজতে খুঁজতেই দিব্যি গল্পের শেষে পৌঁছে যাওয়া যায়। যদিও শুরুর দিকে টানটান ভাবটা বিরতির পরে কিছুটা হলেও আলগা। আর এই ছবির সবথেকে বড় অস্ত্র অভিনয়। কৌশিক সেন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত,, অম্বরিশ ভট্টাচার্য সকলের অভিনয়ই এককথায় প্রশংসার দাবি রাখে বৈকি। পরিচালনার পাশাপাশি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় যে একজন জাত অভিনেতা, তা তিনি এর আগেও বহুবার বুঝিয়েছেন। ‘কাবেরী অন্তর্ধান’-এ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয় আরও একটা বড় প্রাপ্তি। স্থুল চেহারায় তাঁর হাঁটাচলা, গোয়েন্দার ভূমিকায় সেই ধূর্ত দৃষ্টি. অহেতুক বকবক করে মানুষকে বিরক্ত করা, পেটের কথা বের করার চেষ্টা, ছবির শেষ পর্যন্ত মনে গেঁথে যায়। আর প্রসেনজিৎ চট্টেোপাধ্যয়ের দক্ষ অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর চাপদাড়ি লুকটি গল্পের সঙ্গে বেশ মানানসই।
চিত্রনাট্য, পরিচালনা অভিনয়ের পাশাপাশি, এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনাও প্রশংসার দাবি রাখে বৈকি। এই দিকগুলো চিত্রনাট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাহলে গোটা ছবিটিকে সুন্দরভাবে মেলে ধরা সম্ভব হত না। তবে এই ছবিতে কোনও আবহসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়নি, শেষপর্যন্ত রহস্য ধরে রাখতে চিত্রনাট্য যথেষ্ঠ। তবে মাঝে মধ্যে চিত্রশিল্পী অর্ঘকমলের আঙুলের ছোঁয়ায় পিয়ানোর সুরই এই ছবির দৃশ্যে অন্যমাত্রা যোগ করেছে।
নির্ধারিত সূচি মেনেই ২০ জানুয়ারি, শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় জুটির চতুর্থ ছবি ‘কাবেরী অন্তর্ধান’। ছবিঘিরে প্রথমদিনেই দর্শকদের আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে বাকি সময়েও এটিি হলে দর্শক টানতে পারবে। তবে এবার বাকিটা সময়ই উত্তর দেবে।
For all the latest entertainment News Click Here