ইতিহাস মনে রাখবে নারায়ণ দেবনাথকে, কারণ বলছেন এই প্রজন্মের কার্টুনিস্টরা

মঙ্গলবার প্রয়াত হলেন ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘নন্টে-ফন্টে’র স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ। বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। টানা ২৫ দিন ধরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে লড়াই থামল এদিন। নারায়ণবাবুর মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন শিল্পী মহল। দেবাশীষ দেব, উদয় দেব, সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নামজাদা কার্টুনিস্ট এবং ইলাস্ট্রেটররা বিষণ্ণ,স্মৃতিকাতর। ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘নন্টে ফন্টে’কে নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তাঁদের স্রষ্টাকে নিয়ে নিজেদের স্মৃতিকথা উজাড় করেছেন তাঁরা।

তখনও সচল ছিল নারায়ণবাবুর হাত, তৈরি হচ্ছিল নন্টে-ফন্টে।
তখনও সচল ছিল নারায়ণবাবুর হাত, তৈরি হচ্ছিল নন্টে-ফন্টে।



দীর্ঘ বছর ধরে এক বহুল প্রচারিত দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে পাঠকদের নিজের রং তুলির সাহায্যে মনোরঞ্জন করে এসেছেন দেবাশীষ দেব। বিশেষ করে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটদের, কিশোরদের উপন্যাসের সঙ্গে প্রায় তিরিশ বছর ধরে তাঁর ছবির যুগলবন্দী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম থেকেই হিউমারধর্মী আঁকার সুবাদেই তাঁর পরিচিতি। 

নারায়ণবাবুর কথা বলতে গিয়ে দেবাশীষবাবু জানান দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে নারায়ণ দেবনাথ যেভাবে ধারাবাহিকভাবে হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে-ফন্টেদের এঁকে গেছেন এবং টানা সাফল্য পেয়ে গেছেন সারা বিশ্বে এরকম নজির আর নেই বললেই চলে। ‘পাশাপাশি বাঁটুল, নন্টেদের এতটাই আমাদের কাছে আকর্ষণীয় এবং ঘরের মানুষ করে তুলেছিলেন যা অবিশ্বাস্য। ‘বাঁটুল’ তো কালক্রমে বাঙালির কাছে আইকন হয়ে উঠেছে। কমিক্স শিল্পী হিসেবে নারায়ণবাবুর কিন্তু বিরাট প্রাপ্তি এটি। ওঁর আঁকার মধ্যেও যে সহজ সরল বিষয়টি আছে তার একটি আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। অসম্ভব অ্যাট্রাকটিভ। টিনটিন এর স্রষ্টা হার্জ-এর মতো তিনিও লাইন ড্রয়িংয়ে দারুণ পারদর্শী ছিলেন। আর এত ডিটেইলিং। ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলি কখনও বাদ পড়ত না তাঁর তুলি, কলম থেকে। উনি তো মূলত ইলাস্ট্রেটশন করতে করতেই কার্টুনিস্ট হয়েছিলেন তাই এই বিষয়টি ছিল। ইলাস্ট্রেশন বলতে মনে পড়ল নারায়ণবাবুর মতো ওরকম নিখুঁত রিয়্যালিস্টিক ইলাস্ট্রেশন ওরকম সময়ে ভাবা যেত না। তখন তো আর গুগল ছিল না। দৈনন্দিন জীবন থেকে বই, ম্যাগাজিন প্রতিটি আঁকার মধ্যেই এত ডিটেইলিং। অবিশ্বাস্য!’ 

নারায়ণবাবুর হাতে আঁকা হাঁদা-ভোঁদার কমিকস স্ট্রিপের খসড়া।
নারায়ণবাবুর হাতে আঁকা হাঁদা-ভোঁদার কমিকস স্ট্রিপের খসড়া।

সামান্য থেমে দেবাশীষ দেব সামান্য আক্ষেপের স্বরে বললেন, ‘তবে জানেন তো নারায়ণ দেবনাথের অনেক মানেই তো কয়েক প্রজন্মের শৈশব। ওল্ড স্কুল চার্ম। এখনকার প্রজন্ম যদি পিঠে পুলি, পৌষ পার্বণ, রকে বসে আড্ডা কী না জানে তবে হয়ত তাঁদের কাছে নারায়ণ দেবনাথ হারিয়ে যাবে একটা সময়।’

দেবাশীষ দেব এবং উদয় দেব। (ছবি সৌজন্যে - টুইটার)
দেবাশীষ দেব এবং উদয় দেব। (ছবি সৌজন্যে – টুইটার)

বিশিষ্ট কার্টুনিস্ট এবং শিল্পী উদয় দেব এতটুকুও দ্বিরুক্তি না করে জানালেন নারায়ণবাবুর হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। তাঁর শৈশব মানেই বাঁটুল, নন্টে ফন্টেরা। জোর গলায় বলে উঠলেন, ‘পৃথিবীতে যত নামি কার্টুন চরিত্র নিয়ে বছরের পর বছর কাজ হয়েছে তা কিন্তু টিমওয়ার্ক। টিনটিন, অ্যাসটেরিক্স ইত্যাদি। একটু বুঝিয়ে বলি, কেউ গল্প লেখেন, কেউ কার্টুন স্ট্রিপসগুলির চরিত্র স্কেচ করেন কেউ বা রং ভরেন। এই গোটা কাজটি স্রেফ একা হাতে দশকের পর দশক করে গেছেন নারায়ণবাবু। একে ম্যাজিক ছাড়া আর কী বলব? মিরাকল বলাটাই শ্রেয়।বিশ্বে এরকম কাজ আর কেউ করেননি কখনও।’ কেন নন্টে ফন্টেদের এত জনপ্রিয়তা সেই প্রসঙ্গ উঠলে উদয়বাবু জানান তাঁদের ভাষা আদতে আমাদের সাধারণ মানুষের ভাষা। সহজ, মজার এবং কোনও লুকোছাপা ছাড়াই। কমিকসের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। লক্ষ্য করে দেখবেন নন্টে-ফন্টে, হাঁদা ভোঁদারা কিন্তু হাওয়াই চপ্পল পরে। কেউ বুট পরে না। কেউ বিরাট বড় বাড়ির ছেলে নয়। আসলে, তখনকার ছাপোষা মধ্যবিত্তরাই ফুটে উঠেছিল তাঁর রং তুলিতে।

আজও তুমুল জনপ্রিয় নন্টে-ফন্টে। (কবি সৌজন্যে - ফেসবুক)
আজও তুমুল জনপ্রিয় নন্টে-ফন্টে। (কবি সৌজন্যে – ফেসবুক)

এইমুহূর্তে নয়া প্রজন্মের সকলের কাছে অন্যতম প্রিয় কার্টুন চরিত্রের নাম জিজ্ঞেস করলে তাঁদের বেশিরভাগই নাম বলবেন ‘রাপ্পা রাও’-এর। কার্টুনিস্ট এবং জনপ্রিয় ইলাস্ট্রেটর সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুলিতে গত বছর পনেরো ধরে সৃষ্ট হচ্ছে রাপ্পা রায়ের হরেকরকম মজাদার কাণ্ডকারখানা। নারায়ণবাবুর প্রয়াণে যে অত্যন্ত শোকাহত তিনি সেকথা জানানোর পাশাপাশি সুযোগবাবু জোর গলায় বললেন, ‘নারায়ণবাবুর হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। অন্তত আমার তা মনে হয়। এত আন্তর্জাতিক মানের কাজ করেছেন সেসব হারিয়ে যাবে বলে মনে হয় না। একটা কমিকস চরিত্র তৈরি করে তাঁকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি মানুষের মাথায় ও হৃদয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া অত্যন্ত দুঃসাধ্য কাজ। সেটা করতে পেরেছিলেন উনি। তাও আবার একটি নয়, তিন-তিনটি। কীভাবে করলেন? বলা শক্ত। যিনি পারেন, তিনি পারেন। যিনি পারেন না তিনি পারেন না। এই ক্ষমতা কেউ কেউ নিয়ে জন্মান। নারায়ণবাবুর নিজস্ব সিগনেচার ড্রয়িং নিয়ে বলা বাতুলতা তাই বলছিলো না। এত ইন্টারেস্টিং তাঁর স্কেচ, অসামান্য। ওঁর যে তৈরি করা কার্টুনের ভাষা তা দারুণ বললেও কম বলা হবে। যা ওঁর আগে কেউ পারেননি করতে। এবং দু’পাতায় যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গল্প তৈরি করা এবং দশকের পর দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে তা করে যাওয়া একে জিন্যাসের নিদর্শন ছাড়া আর কীভাবে ব্যাখ্যা করব?’

সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সামান্য থেমে বললেন, ‘প্রান এর চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কি সেসময়ও ছিল। কিন্তু আঁকা, ডিজাইন, ডিটেইলিং এর দিক থেকে অন্তত একশো কিমি এগিয়ে ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। দেশীয় গ্রাফিক নোবেলের আজ যে এত রমরমা সেসবের পায়োনিয়ার হিসেবে অবিংসবাদিতভাবে নাম উঠে আসবে নারায়ণবাবুর। ব্যক্তিগতভাবে দু’তিনবার সাক্ষাৎ হয়েছিল আমাদের। আমাকে জানিয়েছিলেন তিনি আমার কাজ দেখেছেন এবং তাঁর নাকি যথেষ্ট ভালো লেগেছে। সেটাই আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ছিল।ওঁকে ভুলতে পারব না কোনও দিন।’

For all the latest entertainment News Click Here 

Read original article here

Denial of responsibility! TechAI is an automatic aggregator around the global media. All the content are available free on Internet. We have just arranged it in one platform for educational purpose only. In each content, the hyperlink to the primary source is specified. All trademarks belong to their rightful owners, all materials to their authors. If you are the owner of the content and do not want us to publish your materials on our website, please contact us by email – [email protected]. The content will be deleted within 24 hours.